খাল উদ্ধার করতে গেলে পাল্টে যাবে সরকার: বাদশা

রাজধানীর পানি নিষ্কাশণের জন্য প্রায় বেদখল ১৬টি খাল সংস্কার করে সরকার যখন ৫৫০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে, তখন খাল উদ্ধার করতে গেলে সরকার পাল্টে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা।
রবিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে জলাবদ্ধতা বিষয়ক সেমিনারে আওয়ামী লীগের শরিক বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা এই সতর্কতা দেন।
‘রাজধানীর জলাবদ্ধতার প্রতিবন্ধকতা ও উত্তোরণের উপায়’ শীর্ষক সেমিনারটির আয়োজন করে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম বাংলাদেশ-সিডিজেএফবি।

বাদশা বলেন, ‘ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানের জন্য চারপাশের নদী ও খালগুলোকে দখলমুক্ত করে নাব্য ও পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। একটি খাল উদ্ধার করতে গেলে সরকারও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কেন না অত্যন্ত প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে খালগুলো। এজন্য ঢাকার চারপাশের নদী ও খালগুলোকে প্রবহমান করতে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’

রাজধানীতে জলাবদ্ধতার জন্য খালগুলো দখল হয়ে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকার ১৬টি খাল উদ্ধারে বিরাট একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আবার আগামীতে ক্ষমতায় আসতে পারলে পান্থপথ, শান্তিনগর, ধোলাইখাল, সেগুনবাগিচার রাস্তা কেটে খাল ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানিয়েছেন, খালগুলোকে বক্স কালভার্ট বানিয়ে ওপরে রাস্তা তৈরি করায় সেটি ক্ষতির কারণ হয়েছে। তিনি খাল খনন করে ওপর দিয়ে সেতুর মতো করে রাস্তা তৈরি করে দেবেন।

বাদশা মনে করেন সব কিছু রাজধানীকেন্দ্রীক হয়ে গেছে। এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে না আসলে পরিস্থিতি টেকসই উন্নয়ন হবে না।
‘দেশের অর্থনীতিসহ সকল কিছু ঢাকাকেন্দ্রীক হয়ে গেছে। কিন্তু এটা হতে পারে না। গাইবান্ধা থেকে লোক এসে ঢাকার শিল্প কলকারখানায় কাজ করবে, এটা সঠিক না। তাদের জন্য সেখানেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকাকেন্দ্রীক সবকিছু করার এই সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে।’

সেমিনারে বক্তারা বলেন, খাল, জলাধার ও নিম্নাঞ্চল দখল-ভরাটের কারণে রাজধানীর জলাবদ্ধতার মূল কারণ। ঢাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে চারপাশের নদী ও বিদ্যমান ৪৩ খালসহ একটি প্রকল্প করে সেনাবাহিনীকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়ার কোনও বিকল্প নেই।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, ‘ঢাকা শহরের পানি কোথায় সরাব? বুড়িগঙ্গার তলদেশে ময়লা-আর্বজনা। আমার জীবনে কখনো দেখিনি এই নদী ড্রেজিং করতে। তুরাগ, বালু দখলদারদের কবলে। ৭০-৭৫টি খাল ছিল। অথচ এখন ৪৩টির চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলোও দখলদারদের কবলে। নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও সেবা সংস্থাগুলো এসব খাল দখলমুক্ত করতে পারছে না।’

‘প্রভাবশালী দখলদারদের খাল উদ্ধারে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দিতে হবে।’
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মিরপুরের সরকারি কর্মচারীদের আবাসন প্রকল্প ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভাসানটেক প্রকল্পের নামে জলাশয় ভরাট করার তীব্র সমালোচনা করেন জামাল মোস্তফা।
ওই জলাশয় ভরাট বন্ধে উচ্চ আদালত ও প্রধানন্ত্রীর নিশেধাজ্ঞা থাকলেও সেসব তারা পাত্তা দিচ্ছে না।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-সিপের নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলুল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকাকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন কাজ হওয়াতে ঢাকামুখী মানুষের চাপ বাড়ছে। আর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এই শহরে বসবাস করায়, সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে।

আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর অরলা মারফি বলেন, ঢাকায় এখন ১ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যা। আর এই জনসংখ্যা প্রতিবছর চার ভাগ হারে বাড়ছে। ঢাকার সমস্যার লাগাম টেনে ধরার এখনই সময়। দেরি কবলে এই শহরকে বাসযোগ্য রাখা সম্ভব হবে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, নদী ও খালের দখলদারিত্ব দেখভালের দায়িত্ব যাদের, তারা সঠিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করছে না। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। এখন ২৬টি খালও সচল নেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শরীফ উদ্দিন বলেন, বিগত ৬-৭ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারায় দেখছি বর্ষাকাল এখন ৬-৭ মাস। যদিও আমরা আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাসকে বর্ষাকাল হিসেবে জানি। অতি বৃষ্টিপাতের কারণে ১৪৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের জনবহুল এই শহরের মাত্র দুই হাজার কিলোমিটার নর্দমা দিয়ে এত অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে ঢাকাশহর তার সক্ষমতা হারিয়েছে। ৭০ লাখের উপরের জনসংখ্যার শহরে বিনিয়োগের আউটপুট কম। তারপরও এই শহরে বড় বড় বিনিয়োগ হচ্ছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, জাইকার সুপারিশ অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫০-১০০ একর জলাধার, খাল ওই সময় অধিগ্রহণ করেছিল। এখন ঢাকা শহরে জমির অধিগ্রহণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারি কোনও সংস্থা জমি অধিগ্রহণ করতে চাচ্ছে না। কিন্তু শহরের বাস্তবতায় জলাবদ্ধতাসহ বেশকিছু সমস্যার সমাধানে জমি অধিগ্রহণ খুবই জরুরি। এখন এটা করা না গেলে ভবিষ্যতে অধিগ্রহণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হবে না।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধে প্রকৌশলী ম ইনামুল হক বলেন, ঢাকা ওয়াসা পানি নিষ্কাশন নর্দমা দিয়ে পয়ঃনিষ্কাশন কাজ করছে। আর কোনও ধরনের শোধন ছাড়াই সেসব খাল ও নদীতে ঢেলে দিচ্ছে। এর ফলে নগরীর আশপাশের জলাভূমি ও চার নদী দূষিত হচ্ছে। এছাড়াও তিনি, খাল উদ্ধার, খাল খনন, প্রশস্তকরণ এবং ঢাকাশহরের ড্রেনেজ বিভাগের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাতে ন্যস্ত করার পরামর্শ দেন।

ঢাকা ওয়াসার পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, ঢাকা শহরের ১২-১৫ ভাগ জলাধারের জায়গায় রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। এই অবস্থায় পানি নিষ্কাশন কাজ খুবই দুরূহ। তবে বিদ্যমান জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধানে ঢাকা ওয়াসা রুটিন কাজের পাশাপাশি মেগা প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে।

অন্যান্যের মধ্যে সেমিনারের আলোচনায় অংশ নেন- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর সুরাইয়া বেগম, সিনিয়র সাংবাদিক তৌফিক আলী প্রমুখ। নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম-বাংলাদেশের সভাপতি অমিতোষ পাল সেমিনারের সভাপতিত্ব এবং সাধারণ সম্পাদক মতিন আব্দুল্লাহ সঞ্চালনা করেন।